সিংহ দরজা পেরিয়ে লাল মোরামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই কে যেন কানের পাশে এসে জানিয়ে দিল, ‘চোপ, দরবার চলছে!’ আকাশের সূর্য তখন ঢলতে ঢলতে পশ্চিমের স্টেডিয়াম পেরিয়ে লালদিঘির জলে ডুব দিয়েছে। পুবের মরা তোর্ষা থেকে দ্রুত ধেয়ে আসছে আঁধার। মোরামের রাস্তার ধারে সুন্দরী উদ্যানের রূপসী ফুলেরা দিনের শেষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ঠিক তখনই ঝলমল করে জ্বলে উঠল আলোর রোশনাই বাইশ পুরুষের কোচ রাজাদের বাড়ির প্রতিটি ঘরে, বারান্দায়, মহল্লায়। মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্বয়ং বুঝি দরবার পরিচালনা করছেন।
বাইশ পুরুষের বংশ হলে কী হবে, রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর পরই কিন্তু রাজবাড়ি তৈরি হয়নি। বরং এই রাজবংশের রাজত্বের শেষ ভাগেই নির্মিত হয় এই রাজপ্রাসাদ। আসলে এই বংশের বহু রাজারই স্বপ্ন ছিল একটা মনের মতো রাজবাড়ি বানানোর। কিন্তু মূলত আবহাওয়ার প্রতিকূলতা এবং সম্ভবত স্থাপত্যজ্ঞানের অভাবেই তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই রাজবাড়ি নির্মাণের পূর্ববর্তী রাজাদের কারও কারও পাকা বাড়ি থাকলেও ছাদ ছিল খড় বা শনের ছাউনির।
Coochbehar Raj bari
কোচ রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ৩৭৭ বছর পরে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর তাঁরও মনে একটা মনের মতো প্রাসাদ তৈরির বাসনা জাগে। নকশা তৈরি করে ফেলেন তৎকালীন প্রখ্যাত ইংরেজ স্থপতি মার্টিন সাহেব। ইতালীয় নবজাগরণের শিল্পচেতনার প্রভাবযুক্ত ত্রিতলবিশিষ্ট এক বিশাল রাজবাড়ির নির্মাণ শুরু হয় ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এই নির্মাণ কাজ চলে একটানা সাত বছর। খরচ হয়ে যায় আট লক্ষ সাতাত্তর হাজার দুশো তিন টাকা।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে এই রাজবাড়ি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একটি তলা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মস্ত এক সিংহ দরজা পেরিয়ে বর্তমান এই রাজবাড়ি ১.৫ মিটার উচ্চ ভিত্তির উপর স্থাপিত দ্বিতলবিশিষ্ট। উত্তরদক্ষিণে ১২০ মিটার প্রশস্ত ৪৭৬৮.৫ বর্গমিটার আয়তনের পেল্লায় এই প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রবেশপথে রয়েছে মস্ত এক গাড়িবারান্দা। সব মিলিয়ে ৬৪টি ঘর, একতলায় ২৪টি, দোতলায় ৪০টি।
একতলায় রয়েছে দরবার কক্ষ। রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জার আদলে নির্মিত এই ঘরেই এক সময়ে বসত বিচারসভা। ওই ঘরের মেঝেতে আজও রয়েছে রঙিন প্রস্তরখচিত শৌর্য ও মহিমার রাজপ্রতীক। এই রাজপ্রতীক কোচ রাজবংশে বহু বার্তা বহন করছে। প্রতীকের মধ্যে অবস্থিত পশুরাজ পরাক্রমতার নির্দেশক, গজ রাজবৈভবতার বার্তা দেয়। ন্যায়-বিচারের প্রতীক তুলাদণ্ড, সংগ্রামের প্রতীক কৃপাণ, বন্ধনের প্রতীক বলয়, কুলশীলতার প্রতীক কুসুমিত পদ্ম এবং ধর্মরক্ষকের প্রতীক গদাধর হনুমান সমন্বিত হয়ে রাজপ্রতীককে আলাদা মর্যাদা দান করেছে। আর এই রাজপ্রতীকের নীচে লেখা কোচ রাজবংশের মূলমন্ত্র ‘যতোধর্মস্ততোজয়ঃ’ কথাটি।
The Cooch Behar Palace, of the royal Koch dynasty
দরবার কক্ষটি গোলাকার এবং ৩৮ মিটার উচ্চ দ্বাদশ কোণাকৃতি কারুকার্য সমন্বিত। এই কক্ষের উপরের দিকে রয়েছে দরবার কক্ষে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের জন্য বারোটি আলোক বাতায়ন। এবং নীচের দিকে গোলাকার ঝুলবারান্দা। এক তলায় অন্যান্য কক্ষগুলির মধ্যে অন্যতম হল অতিথিশালা, পাকশালা, ভোজনকক্ষ, পুস্তকাগার, বিলিয়ার্ড খেলারঘর এবং তোষাখানা। দোতলায় ছিল অন্দরমহল। দক্ষিণ দিকে মহারাজ আর মহারানির থাকার ব্যবস্থা। অন্য অংশে রাজকুমার, রাজকন্যা এবং রাজপরিবারেরই অন্য সদস্যদের মোট পনেরোটি শয়নকক্ষ, তিনটি বৈঠকখানা, চারটি তোষাখানা, এগারোটি স্নানাগার এবং সুদৃশ্য একটি নাচঘর। প্রতিটি ঘরেই ছিল মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র। ছিল দামি কিছু তৈলচিত্র। বারান্দায় সারি সারি ঝোলানো থাকত হাতি, গণ্ডার, বনমহিষের মাথা বা শিং।
কোচ বংশের রাজ্যপাট শেষ হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর। মহারাজ জগদীপেন্দ্রনারায়ণের হাত থেকে শাসনভার আসে ভারত সরকারের হাতে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া। সম্প্রতি রাজপ্রাসাদের বারোটি কক্ষ সাধারণ দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহান্তে শনিবার ও রবিবার রাতে প্রাসাদ জুড়ে জ্বালানো হয় অসংখ্য বাতি। জাঁকিয়ে বসে আলোর মেহফিল।