একটি রহস্যময় পানীয়-বৃত্তান্ত_নির্মল কর_THE COOL EXPERIENCE

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভারতে কোক-পেপসি মৌরসিপাট্টা গড়ে তোলার পর সারা বিশ্বের মতো এ দেশেও ‘কোকাকোলা’ বা কোক নামের নরম পানীয় মানুষের সব থেকে আদরের পানীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে পানীয়-শিল্পকে পুরোপুরি জাতীয়করণের আওতায় আনতে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির জালে জড়িয়ে এই বিদেশি পানীয়কে সাতাশ বছরের একচেটিয়া বাজার ফেলে এ দেশ থেকে পাততাড়ি গুটোতে হয়। ফলে দেশ জুড়ে পড়ে রইল তার বাইশটি বটলিং প্ল্যান্ট এবং চার কোটি খালি বোতল। তবে শীতল আমেজের যে স্মৃতি কোকাকোলা রেখে যায়, তার অনুসারী কিছু ভারত-ব্র্যাণ্ডের ঠাণ্ডা পানীয় বিজ্ঞাপনের চমকে বাজার জমানোর চেষ্টা করলেও ম্লান করতে পারেনি কোকাকোলার সুনাম। তার ‘রিয়েল থিং’-এর এমনই জাদু—স্বাদে সৌরভে আর মানে। তার পর ১৯৯৪ সালে দেশের শিল্প ও রফতানির ক্ষেত্রে যখন উদার অর্থনীতির হাওয়া বইল, তখন মানুষের তৃষ্ণা নিবৃত্তি করতে ফিরে এল স্মৃতির কোক, তার ঢেউ খেলানো অক্ষরের পুরনো সেই ধাঁধা নিয়ে—‘হাফ সার্কল ফুল সার্কল, হাফ সার্কল এ, হাফ সার্কল ফুল সার্কল, রাইট অ্যাঙ্গল এ’, যার জবাব ‘COCACOLA’, বিজ্ঞাপনের ভাষায় যে নামটি এখন ‘দ্য কুল এক্সপিরিয়েন্স’!

pemberton

পুনরাগমনের প্রায় এক দশক ধরে ভারতের মানুষের কাছে বিশ্বজয়ী এই রমণীয় কোক এখন আসামির কাঠগড়ায়। কারণ, কোম্পানির বারোটি ঠাণ্ডা পানীয়ের নমুনা বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্ট’ (CSE) জেনেছে, তাতে মানব ও উদ্ভিদ-দেহের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর কীটনাশক, নানাবিধ পোকামাকড় বিনাশকারী রসায়ন দ্রব্যাদির ককটেল এমন বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে, যার প্রভাবে পাকস্থলির মারণরোগ ডেকে আনতে পারে, শরীরে হাড়ের খনিজ পদার্থের ঘনত্ব কমাতে পারে, আঘাত হানতে পারে স্নায়ুতন্ত্রে এবং দেখা দিতে পারে জন্মকালীন সমস্যা। কোক-বটলিং প্ল্যান্টের বর্জ্যেও পাওয়া পাওয়া গেছে বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম ও সিসা। ক্যাডমিয়াম বিকল করতে পারে কিডনি। সিসার প্রভাবে শিশুদের মধ্যে দেখা দিতে পারে মানসিক জড়তা ও ভয়াবহ রক্তাল্পতা!

বোতলজাত যে কোনও পানীয়তে জল থাকে নব্বই শতাংশ। বাকি দশ শতাংশ চিনি, গ্লুকোজ, ফলের মণ্ড ও রঙ বিশেষ। জলের ক্ষেত্রেও বিধিবদ্ধ নির্দেশে বলা আছে যে, পানীয় তৈরিতে পানযোগ্য জল ব্যবহার করতে হবে। পানীয় কোম্পানিগুলো ভূগর্ভস্থ যে জল ব্যবহার করে তাতে থাকে কীটনাশক। কিন্তু ওই কীটনাশকের উপস্থিতির যে ঊর্ধ্বসীমা ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন বেঁধে দিয়েছে, নরম পানীয়ের পরীক্ষিত নমুনাগুলোর প্রতিটির মধ্যে কীটনাশকের মাত্রা তার থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি আছে বলে অভিযোগ। তাই এ দেশে দ্বিতীয় বার ধাক্কা খাওয়া এই দিগ্বিজয়ী ‘ডেলিশিয়াস অ্যাণ্ড রিফ্রেশিং কোলা’ থেকে আতঙ্কিত মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিশ্বের ১৮৫টি দেশে যার জাল ছড়ানো, এ দেশে কোটি কোটি টাকার কোক-পেপসির বিক্রির বোতলের সংখ্যাই নাকি ৬৫৪ কোটি। সেই ব্যবসা এখন ঠাণ্ডা। অথচ জনপ্রিয়তার শিখরে কোকাকোলার স্থান। আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি অনুরূপ পানীয় তৈরি করা। কারণ, কোকাকোলার স্বাদের রহস্য এবং উপাদান আজ পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। এ পানীয় নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। কিন্তু ক’জন জানেন রহস্যময় কোকাকোলার ইতিহাস আর তার জন্মবৃত্তান্ত!

জন স্মিথ পেমবার্টন নামে আটলান্টার এক হাতুড়ে ডাক্তার নিজের তৈরি ওষুধপত্র ফেরি করে বেড়াতেন। তিনি শুধু ওষুধই তৈরি করতেন না, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটি সুস্বাদু ‘সফ্‌ট ড্রিঙ্ক’ আবিষ্কারের নেশায় নানা ভেষজের সঙ্গে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাতেন। প্রথমদিকে তাঁর তৈরি একটি সিরাপ সোডা-শরবত হিসাবে বিক্রি হত গ্লাস পিছু পাঁচ সেন্ট-এ। একবার ওই সিরাপের সঙ্গে কোকা গাছের পাতার নির্যাস মিশিয়ে ‘ভিন মারিয়ানি’ নামে একটি পানীয় প্রস্তুত করলেন, যা ওষুধের দোকানে নার্ভ সতেজ রাখার টনিক হিসাবে বিক্রি হত। কিন্তু একটি আদর্শ ‘সফ্‌ট ড্রিঙ্ক’-এর নেশা তখনও তাঁকে ছাড়েনি। আফ্রিকার অরণ্যবাসীরা তৃষ্ণা নিবারণ এবং শরীর চনমনে রাখতে কোলাগাছের বাদাম চিবিয়ে খেত। ব্যাপারটা জানতেন পেমবার্টন। তিনি তাঁর ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে শুকনো কোলা-নাটের গুঁড়ো পরীক্ষা করে দেখলেন তার মধ্যে রয়েছে ক্যাফেইন ও থিওব্রোমিন, যার মিশ্রণ স্টিমুল্যান্ট বা উত্তেজক ওষুধের কাজ করে। তাঁর চালু সরবতের সঙ্গে কোলা-নাটের গুঁড়ো, চিনি এবং কিছু সুগন্ধি উপাদান মিশিয়ে পেমবার্টন তৈরি করলেন নতুন স্বাদের বুদবুদ-কাটা গাঢ় রঙের এক পানীয়। তার পর একদিন ওই পানীয়-ভর্তি তেপায়া চাকাযুক্ত একটি বড় পেতলের পাত্র ঠেলে নিয়ে গেলেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ফ্র্যাঙ্ক রবিনসনের কাছে। ওই ফেনিল পানীয় আস্বাদন করে উল্লসিত রবিনসন তৎক্ষণাৎ এর নামকরণ করলেন ‘কোকাকোলা’। সেটা ১৮৮৬ সালের কথা। বাঁকা লিখন-শৈলীতে কোকাকোলার একটি সুন্দর লোগোও তৈরি করে দিলেন, যা আজ পৃথিবীর সব থেকে চেনা ‘ট্রেডমার্ক’। কিন্তু অদূরদর্শী পেমবার্টন নিজের প্রতিভা এবং আপন সৃষ্টি-মাহাত্ম্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না বলে তাঁর ব্যবসার শেয়ার একটু একটু করে নানাজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন। ১৮৮৯ সালে এ জি ক্যাণ্ডলার নামে এক দুঁদে ব্যবসায়ী ফর্মুলা-সহ পেমবার্টনের ওই আশ্চর্য পানীয়ের সমস্ত শেয়ার কিনে নিলেন। বছর তিনেক পর পেমবার্টনের অভিজ্ঞ পার্টনার রবিনসন এবং আরও দু’জনকে নিয়ে এক লাখ ডলার পুঁজিতে খুললেন কোকাকোলা কোম্পানি। ক্যাণ্ডলার পেমবার্টনের কাছ থেকে প্রাপ্ত পানীয়ের সঙ্গে কার্বনেটেড ওয়াটার বা অঙ্গারাম্লযুক্ত জল মিশিয়ে এক রসনামুগ্ধ পানীয় উপহার দিলেন। ক্যাণ্ডলারই প্রথম ব্যক্তি যিনি কোকাকোলাকে এতটা জনপ্রিয় করে তোলেন। ফলে নতুন স্বাদের এই ‘কোক’ বাজারে হু হু করে বিকোতে লাগল। প্রথমে গ্লাসে গ্লাসে শরবত হিসাবে বিক্রি হলেও বোতলভর্তি কোকাকোলা বিক্রি শুরু হয় ১৮৯৪ সালে। দেখতে দেখতে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে কোকাকোলা এক অপরিহার্য পানীয় হয়ে উঠল। আমেরিকাই কিন্তু কোকাকোলার সব চেয়ে বড় ক্রেতা। গড়ে একজন আমেরিকান বছরে অন্তত ৫০ গ্যালন কোক গলাধঃকরণ করেন। কোকের কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে একটি মজার খবর দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত যত কোকাকোলা উৎপাদন করা হয়েছে তা যদি নায়েগ্রা প্রপাতের বিস্তীর্ণ অংশে ঢেলে দেওয়া হয়, তা হলে সব পানীয় শেষ হতে নাকি সময় লাগবে ২০ ঘণ্টা।

কোকাকোলার অসামান্য সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার কারণ তার স্বাদ এবং উপাদান-রহস্য। আর এর উত্তরোত্তর ব্যবসা বৃদ্ধির মূলে রয়েছে বিজ্ঞাপনের কৃৎকৌশল। গোড়ার দিকে কোকের বিক্রি সীমাবদ্ধ ছিল গ্রীষ্মকালে। কর্তৃপক্ষ চিন্তায় পড়ে গেলেন। অনেক মাথা খাটিয়ে ১৯২২-এর ডিসেম্বরে পুরো পাতা জুড়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন: ‘থার্স্ট নোওজ নো সিজন’! চারটি শব্দের ওই বিজ্ঞাপন কয়েকবার ছাপাবার পর ম্যাজিকের মতো কাজ হল। শীতেও বিক্রি এত বাড়তে শুরু করল যে, প্রস্তুতকারকরা হিমসিম খেয়ে গেলেন।

কোকাকোলার গোপন ফর্মুলা এবং উপাদান রহস্য নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা দীর্ঘদিনের। আসলে কোকের আবেদনকে আরও আকর্ষক ও রহস্যময় করে তুলতেই পানীয়টির উপাদানগুলো নিয়ে এত গোপনীয়তা। আমেরিকার ট্রাস্ট কোম্পানি অব জর্জিয়া নামের ব্যাঙ্কের সেফ্‌ ডিপোজিট ভল্টে ‘7x’ চিহ্নিত কোকের ‘রিয়েল থিং’টি সযত্নে রাখা হয়েছে। যে সব রসায়নবিদ মূল ফর্মুলার সাহায্যে কোকাকোলা উৎপাদন করেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন না কোন উপাদানের কী নাম। কারণ, লেবেলহীন বোতলে ভরা থাকে বলে ওগুলো চেনার একমাত্র উপায় উপাদানের রূপ গন্ধ এবং অবস্থিতি। যে দশ জন অফিসারের হাতে ফর্মুলার চাবিকাঠি রয়েছে, তাঁদের একসঙ্গে বসবাস এবং চলাফেরা নিষিদ্ধ, পাছে তাঁরা অপহৃত হন বা দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

কোকের রহস্য-উদ্ঘাটনে কিছু গবেষক বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন। কেউ কেউ রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবিও করেন। আমেরিকার উইলিয়াম পাউণ্ড স্টোনও কোক-রহস্যের হদিশ দিয়েছেন তাঁর ‘বিগ সিক্রেটস’ গ্রন্থে। কোক-পানীয়তে যে সব সম্ভাব্য উপাদানের কথা বলেছেন সে সব হল—চিনি, ক্যাফেইন, ক্যারামেল, ফসফরিক অ্যাসিড, কোক-পাতার নির্যাস, কোলা-নাট, সাইট্রিক অ্যাসিড, কমলালেবু, লাইম-জুস, দারুচিনি, জায়ফলের তেল, গ্লিসারিন, ভ্যানিলা এবং ‘সেভেন এক্স’ নামের এক ‘রিয়েল থিং’। কিন্তু ‘সেভেন এক্স’টা যে কি সেটা তিনিও জানাতে পারেননি। এদিকে ‘বিগ সিক্রেটস’ প্রকাশের পর কিছু তাবড় প্রতিযোগী-পানীয় কোম্পানি বাজার মাৎ করতে ওই সব উপাদান অনুসরণে নতুন পানীয় প্রস্তুত করে বাজারে ছাড়লেন। কিন্তু কোকের রমণীয় স্বাদ কেউ আনতে পারলেন না। কারণ, উপাদানগুলোর অনুপাত সম্পর্কে কোম্পানির অ্যানালিস্টদের সঠিক ধারণা ছিল না। আরও এক অন্যতম কারণ, পানীয়তে কোকা ও কোলার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। আসলে কোকের স্বাদ সৃষ্টি করতে ও দুটির ভূমিকা যৎসামান্য।

কোকাকোলা উৎপাদনের গোপনীয়তাকে ভর করে বিশ্বজুড়ে গুজবও কম রটেনি। ১৯৫৪ সালে মরক্কোর লোকেরা প্রচার করলেন কোকে শুয়োরের রক্ত মেশানো হয়। নিগ্রোরা প্রচুর পরিমাণে কোক-পানের পর মাতলামি শুরু করেন। তাঁদের রটনা, পানীয়তে কড়া-ডোজের কোকেন মেশানো থাকে। গুজব ছড়াতে ভারতীয়রাও পিছিয়ে থাকেননি। তাঁরা বললেন, কোকে মেশানো হয় মানব-শরীরের বর্জ্য পদার্থ। নানা মহলে এমন অভিযোগও ওঠে যে, কোকাকোলায় কফির উপক্ষার, চিনি ও ফসফরিক অ্যাসিডের বহুল ব্যবহারের ফলে দাঁত ক্ষয়ে যায়।

একটি পানীয়কে নিয়ে এত হইচই এবং অভিযোগ শুনে ১৯০৯ সালে আমেরিকার ফেডারেল সরকার কোকের গোপন ফর্মুলা জানতে আদালতের দ্বারস্থ হয়। দীর্ঘ ন’বছর মামলা চলার পর বিচারকের রায় গেল কোম্পানির পক্ষে। সুতরাং সব অভিযোগ এবং বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে কোকের দিগ্বিজয় ও জনপ্রিয়তা কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যায়। একশো সতেরো বছর ধরে তৃষ্ণার্তদের মধ্যে কোকাকোলা যে ভুবন-জুড়নো শীতল-তৃপ্তির অনুভূতি এবং আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়েছে, তার বিকল্প সন্ধান বোধহয় কোনও দিনই শেষ হবে না! কিন্তু পানীয়ের নামে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে এই অভিযোগে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো এই সুরভিত পানীয়কে কি এই উপমহাদেশ থেকে ফের তল্পি গুটোতে হবে?

https://www.facebook.com/l.php?fb_ref=homepage