ঐতিহাসিক ময়ূরতক্ত
পাপড়ি ভট্টাচার্য
ময়ূরসিংহাসনে শাহজাহান।
সম্রাট শাহজাহান বাদশাহের সাতটি রত্নময় সিংহাসন ছিল। তার মধ্যে সব চেয়ে উৎকৃষ্ট সিংহাসনটি হীরকনির্মিত। এই সিংহাসনের গভীরতম রহস্য সৌন্দর্য আর মণিমুক্তোর অবস্থান, পরিমাণ, মূল্য এবং এর অবসানের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে।
কাঠের পালঙ্কের মতো এই সিংহাসনটি ৩ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট চওড়া। এর চারটি খুর, দুটি ২০ ইঞ্চি এবং অন্য দুটি ২৫ ইঞ্চি উঁচু। ওই চারটি খুরের সঙ্গে বাজু সংলগ্ন থাকত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ ইঞ্চি। এই বাজুগুলো সবই সোনার তৈরি। আবার সেই সোনার উপর হীরে, মুক্তো, চুনি, পান্না, নীলকান্তমণি, পদ্মরাগমণি আর নানা রঙে রঞ্জিত বহুমূল্য পাথর পরিপাটি করে সাজানো ছিল। একটি বাজুর উপর তিনটি করে সূক্ষ্ম স্তম্ভ আছে। তার মধ্যে তিনধারের নয়টি স্তম্ভের সঙ্গে তিনটি চন্দ্রাতপ সংলগ্ন আছে। আর অবশিষ্ট ধার অর্থাৎ সামনের দিকে বিচারকার্যের জন্য ফাঁকা ছিল। প্রত্যেক বাজুতে চতুষ্কোণ ভাবে চারটি পান্না ও মধ্যে একটি চুনিপাথর আর চারটি চুনিপাথরের মধ্যে একটি করে পান্না ক্রমান্বয়ে সুসজ্জিত হয়ে এক একটি চুনি ও পান্না এক একটি তারার মতো শোভা পেত। ঠিক এই ভাবেই অন্য ধারের বাজুতে চতুষ্কোণ ভাবে চারটি জ্যোতির্ময় পান্নার মধ্যে একটি পদ্মরাগমণি ও চারটি তেজোদীপ্ত পদ্মরাগমণির মধ্যে একটি জ্যোতির্ময় পান্না খচিত হয়ে আঁধারে ঢাকা গাছপালার অন্তরালে চাঁদের মতো শোভাবর্ধন করত এবং অবশিষ্ট বাজু দুটিতে বৃত্তাকার ভাবে কেন্দ্রস্থলে পান্না দিয়ে বেষ্টিত হয়ে ওই পাশেও আরেক দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত। চুনিপাথর ও পান্নার মধ্যবর্তী স্থান হীরে দিয়ে আবৃত। প্রত্যেক হীরে প্রায় ওজনে ৪০ রতিরও উপর হবে। সিংহাসনের কোনও কোনও অংশ মুক্তো আর সোনা দিয়ে মোড়া। এর একদিকে সিংহাসনে আরোহণ করার জন্য একটি সোপান আছে।
এই সিংহাসনের চারদিকে ঢাল, তলোয়ার, ধনুর্বাণ, গদা ও অন্যান্য নানা প্রকার অস্ত্র লম্বমান দেখা যায়। প্রত্যেক অস্ত্রকোষই বহুমূল্য প্রস্তর-নির্মিত।
এই সিংহাসনের পূর্বোক্ত তিনটি চন্দ্রাতপের নীচের দিক হীরে ও মুক্তোয় খচিত এবং চারপাশে মানিকের ঝালর আছে। এই চন্দ্রাতপের মধ্যে একটি চতুষ্কোণ গম্বুজের উপর একটি কৃত্রিম ময়ুূর দেখা যায়। এই সোনার ময়ূরের গায়েও নানা বর্ণের পাথর ও মণিমুক্তো খচিত। ময়ূরের ঠিক বুকের মাঝখানটিতে একটি বড় পদ্মরাগমণি আছে। এবং ওই পদ্মরাগমণির সঙ্গে প্রায় ২০০ রতি ওজনের একটি গোল মুক্তো সংলগ্ন আছে। ময়ূরপুচ্ছ নীলকান্তমণি ও নানা রঙের পাথর বেষ্টিত। ময়ূরটির দু’পাশে নানা রত্নে খচিত সোনার দুটি পুষ্পস্তবক আছে। এই তক্ততাউসের গঠন এমনই চমৎকার যে সম্রাট সেখানে উপবেশন করামাত্র ময়ূরের নৃত্যকালীন দৃশ্যের মতো ওই কৃত্রিম ময়ূরটি দেখা যেত এবং তার পেখমে বসানো সমস্ত মণিমুক্তো ভাগে ভাগে দৃষ্টিগোচর হত। ওই পুচ্ছে পান্না ও চুনি দ্বারা বেষ্টিত প্রায় ৩৫০ রতি ওজনের একখণ্ড হীরে আছে। ওই হীরে সব চেয়ে মূল্যবান। এই জন্যই সিংহাসনটির নাম ময়ূরতক্ত বা ময়ূরসিংহাসন।
ময়ূরসিংহাসনটির দু’পাশে দুটি আতপত্র ও চার হাত লম্বা লাঠি দাঁড় করানো আছে। আতপত্রের বৃন্তদুটি ও লাঠিগুলি মণিমুক্তো ও হীরে দিয়ে নির্মিত। আতপত্র দুটির উপরিভাগ বুটি দেওয়া লোহার মখমল নির্মিত ও চারদিকে হীরের ঝালর আছে।
এই ময়ূরসিংহাসনটির অবস্থান ছিল বাদশাহের বিচারাগারে। সিংহাসনে যে কত প্রকার মণি, মুক্তো, প্রবাল ও বহুমূল্য পাথর খোদাই করা আছে তার প্রকৃত বিবরণ আমরা জানি না। ইউরোপীয় আটজন ভ্রমণকারী বলেন যে, এতে ১০৮টি চুনিপাথর আছে, তার মধ্যে সব চেয়ে ছোটটির ওজন প্রায় ৪০০ রতি। সব চেয়ে বড়টির ওজন ৭০০ রতিরও বেশি হবে। তাঁরা আরও বলেন যে, পদ্মরাগমণির সংখ্যা চুনিপাথর অপেক্ষা ১০৮-এর বেশি। তার মধ্যে ছোটটির ওজন ১২০ রতি ও বড়টির ওজন ১৮০ রতিরও বেশি হবে। এ সব ছাড়াও হীরে, সোনা, পদ্মরাগমণি, নীলকান্তমণি ও নানা রঙের মূল্যবান পাথরও আছে। এর মধ্যে অধিকাংশের রঙ এত উজ্জ্বল ও আকর্ষক যে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়।
এই সব রত্ন শাহজাহান নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এতে Balass (চুনিপাথরের মতো) এক রকম রত্ন খচিত আছে। এগুলো তিনি অক্ষস নদীর তীরবর্তী বদাক্ষসন রাজ্যের অন্তর্গত প্রদেশের ঝিনুক থেকে তুলে আনেন।
প্রসিদ্ধ ইউরোপীয় মণিকারেরা স্থির করেছেন যে সর্বসমেত ওই সিংহাসনের মূল্য প্রায় ১৬,০৫,০০,০০০ লিভর (Liver) বা ১০,৭০,০০,০০,০০০ টাকা।
এই ময়ূরসিংহাসন প্রথম সূত্রপাত করেন ভারত লুণ্ঠনকারী তৈমুরলঙ, তারপর তাঁরই বংশধর বিলাসপ্রিয় শাহজাহান এর নির্মাণ শেষ করেন। আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসের অহংকার এই ময়ূরসিংহাসনের অবসান বড় বেদনার। নানা হাত হয়ে এই ময়ূরসিংহাসনের বড় শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল। আহম্মদ শার উত্তরাধিকারীগণ অত্যন্ত দুর্বৃত্ত ছিল। এরা সব সময় একটি একটি করে মণি, মুক্তো, হীরে আর বহুমূল্য পাথরগুলো তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। এই ভাবে শিয়াল কুকুরের আঁচড় কামড়ের মতো সেই বিশ্বখ্যাত ময়ূরতক্তটি ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩ বৈশাখ ১৪১০ রবিবার ২৭ এপ্রিল ২০০৩
‘ঐতিহাসিক ময়ূর-তখ্ত্’
রবিবারে আনন্দমেলায় ২৭ এপ্রিল ‘ঐতিহাসিক ময়ূরতক্ত’ লেখাটির শুদ্ধ শিরোনাম হবে ‘ঐতিহাসিক ময়ূর-তখ্ত্’। তা ছাড়া লেখা হয়েছে, ‘উৎকৃষ্ট সিংহাসনটি হীরকনির্মিত।’ শুধু হীরক দিয়ে কিছু গড়া যায় না। লেখা উচিত ছিল ‘হীরকখচিত’। দু’টি অদ্ভুত শব্দ ‘অক্ষস’ ‘বদক্ষসনা’। এ দু’টি হবে অক্সাস্ (গ্রিক অক্সুস্) এবং বদখ্শান। বর্তমান তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানে প্রবাহিত অক্সাস (Oxus) নদীর স্থানীয় নাম আমুদরিয়া। বদখ্শান্ শহর তাজিকিস্তানে অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে সমগ্র অঞ্চলটি গ্রিকদের বাক্ত্রিয়া (Bactria) রাজ্য ছিল। যাই হোক, পারস্যসম্রাট নাদির শাহ্ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তৎকালীন দিল্লির মোগল বাদশাহ্ মুহাম্মদ শাহের কাছ থেকে ওই ময়ূর সিংহাসন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাহজাহানের ওই সিংহাসনের প্রকৃত নাম ছিল ‘তখ্ত্-ই-তাউস’। কথাটি ফারসি। তখ্ত্ = সিংহাসন। ই = সংযোজক পদ। তাউস = ময়ূর। শাহজাহানের হুকুমে গড়া সিংহাসনটিতে কতরকম ধাতুরত্ন কত পরিমাণে ছিল, তা নিয়ে নানারকম গল্পগাছা আছে। কোনটা সত্য, তা নির্ণয় করা অসম্ভব। অবশ্য এ নিয়ে কিছু লেখা যেতেই পারে। তবে মূল বিষয়টি যেন ভ্রান্তিপূর্ণ না হয়। এ বার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। বাংলা বাগধারায় ‘দূর অস্ত্’ এই ফার্সি কথাটি চালু আছে। যাঁরা দিল্লির লালকেল্লায় সন্ধ্যাবেলায় ‘সনে লুমিয়া’ অনুষ্ঠান শুনেছেন, তাঁদের মনে পড়বে, নাদির শাহ্ দিল্লি আক্রমণ করতে আসছেন, এই খবর দিতে ব্যাকুল দূতকে রঙ্গমহলে নর্তকীদের নাচগানের আসরে মত্ত অর্থাৎ পানোন্মত্ত মুহাম্মদ শাহ্ জড়িত কণ্ঠস্বরে বলছেন, ‘দেহ্লি হনুজ্ দূর অস্ত্’ (দিল্লি এখনও দূরে আছে)! ময়ূর সিংহাসন লুণ্ঠনের কথা না থাকায় এ বিষয়ে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কলকাতা-১৪