তিন নম্বর মেরু! তা হবে। পৃথিবীর তৃতীয় মেরু হিসেবে এই শৃঙ্গটাকে প্রথম দাগিয়েছিলেন ক্লিন্টন ডেন্ট, সেই ১৮৮৫ সালে তখনও দুই মেরুর কোনওটাতেই মানুষ পৌঁছায়নি। তিনি ছিলেন শল্যচিকিৎসক, মানুষের সহ্যের সীমা কতদূর তার একটা মাপ কষে বুঝতে পেরেছিলেন মেরু অভিযান যদি মানুষ সইতে পেরে থাকে, তবে এভারেস্টের দরজা তার কাছে খোলা। কিন্তু সহজ মোটেও নয়। যদিও এভারেস্টই প্রথম জয় করা পর্বতচূড়া নয়, তাছাড়া এভারেস্টের মাত্রই দু বছর আগে অন্নপূর্ণার চূড়ায় উঠে পর্বত অভিযাত্রীদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন মরিস হারজগ— অনেকের মতে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে ওঠা ছিল এভারেস্টের থেকেও কঠিন কাজ— তবু এভারেস্ট এভারেস্ট। আজ পঞ্চাশ বছর বাদেও এর আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। হিলারি ও তেনজিং-এর পর কম করেও ১২০০ মানুষ এই শৃঙ্গে পা রেখেছেন, একাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৫ জনেরও বেশি। বিভিন্ন দল বিভিন্ন সময়ে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন আলাদা আলাদা অন্তত পনেরোটা পথে। তাঁরা নতুন নতুন পথ খুঁজেছেন তা আরও সহজ হবে বলে নয়, বরং উল্টোটাই— আরও আরও কঠিন পথে নিজেকে পাঠিয়ে এঁরা দেখতে চাইছেন, এভারেস্ট নয়, মানুষের নিজের সীমানা কতদূর। ভারত থেকে দু বার সফল অভিযান হয় — ১৯৬৫তে প্রথমবার, দ্বিতীয় ১৯৮৪তে, যে বছর বাচেন্দ্রি পাল এভারেস্ট শৃঙ্গে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এভারেস্টে উঠেছেন এমনকী একজন অন্ধ মানুষও— এরিক হ্বাইহেনমেয়ার, ২০০১-এ। ভাবা যায় না, ওই বছরেই এক দিনে পরপর এভারেস্টে উঠেছিলেন ৮৯ জন! আরও অনেক খবরই এভারেস্টের রেকর্ড বইতে জায়গা পাবার যোগ্য। কিন্তু রেকর্ডই তো সব নয়।
Annapurna Range as seen from Sarangkot, Pokhara in Nepal
এভারেস্টের সঙ্গে যুগে যুগে যে-মানুষরা জড়িয়ে আছেন, তাঁরা এভারেস্টের থেকেও রোমাঞ্চকর। যেমন খোদ জর্জ এভারেস্ট, উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের জরিপ বিভাগের সর্বময় কর্তা, যাঁর নেতৃত্বে এদেশের দুর্গম জায়গাগুলো জরিপের আওতায় এসেছিল। যেমন ১৮৫২-য় রাধানাথ শিকদার— তার বছর তিনেক আগে হিমালয়ের জরিপে ‘পিক ফিফটিন’ বলে দাগানো মোটেও-আহামরি-নয় একটা শৃঙ্গের মাপজোখগুলোয় ত্রিকোণমিতি খাটিয়ে দেখতে দেখতে বুঝেছিলেন এর থেকে উঁচু বিন্দু পৃথিবীতে আর নেই। এভারেস্ট নিজে চাননি, কিন্তু ১৮৬৫তে জরিপবিভাগে তখনকার সর্বময় কর্তা অ্যাণ্ড্রু ও’ এভারেস্টেরই নাম যোগ করে দিয়েছিলেন বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গের সঙ্গে।
সেদিনে দুই সফল অভিযাত্রী: নোরগে এবং হিলারি
যেমন জর্জ লে মালোরি নামের সেই স্কুলমাস্টার, এভারেস্ট অভিযানের শিবিরে বসে সঙ্গী আরভিনের সঙ্গে যিনি শেকসপিয়ার পড়তেন, এভারেস্টের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শুধু যে ১৯২৪-এ এভারেস্টের পথে যেতে যেতে অ্যাণ্ড্রু আরভিনের সঙ্গে এঁর রহস্যময় অন্তর্ধানই এর কারণ তা নয়, এই শৃঙ্গে অভিযান শুরু হয়েছিল অনেকটাই ওঁর উদ্যোগে।
যেমন মরিস উইলসন, একজন খ্যাপাটে মানুষ, একা একটা ছোট এরোপ্লেনে চড়ে এভারেস্টের গায়ে আছড়ে পড়বেন বলে ভেবেছিলেন, তার পর বাকি পথটা হেঁটে যাওয়া আর এমন কী! ইংরেজ সরকার বাগড়া দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত এরোপ্লেন ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছিলেন, তখন ১৯৩৪। এভারেস্টের পথে কিছুদূর গিয়ে তিনিও হারিয়ে যান।
এই মানুষগুলি এভারেস্টকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন, তাঁদের জেদ দিয়ে, বোকামো দিয়েও হয়তো বা। কিন্তু রাইনহোল্ড মেসনারকে কেউ বোকা বলবে না। এভারেস্ট অভিযানের গোড়া থেকেই একদল মানুষ পাহাড়ে বোতলভরা অক্সিজেনের সাহায্য নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন, এতে যেন প্রকৃতিকে ধোঁকা দিয়ে নিজের কৃতিত্ব বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ’৭৮-এর আগে অবধি সমস্ত অভিযানেই অক্সিজেন ছিল বড় অবলম্বন। ওই বছর মেসনার এবং তাঁর সঙ্গী পিটার হ্যাবেলার এভারেস্টে উঠলেন অক্সিজেন ছাড়াই। তার দু বছর বাদে এভারেস্টে আবার মেসনার, এবারও অক্সিজেন ছাড়া, কিন্তু এবার তিনি সম্পূর্ণ একা, এমনকী সাহায্য চাইবার জন্য কোনও রেডিও-ও নেই সঙ্গে। হিলারিদের সময় প্রায় ৩৫০ জন মালবাহক বয়ে নিয়ে গিয়েছিল অভিযানের ১০ টন মালপত্র।
১৯৫৩র এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে যে অভিযানের শেষ পর্বের শুরু, তা সমাপ্ত হয়েছিল ২৯ মে তারিখে। ২৯ মে তেনজিং-হিলারি শীর্ষে পৌঁছনোর তিন দিন আগেই তাঁদের অপর দুই সঙ্গী চার্লস ইভান্স এবং টম বোর্ডিলন একবার শৃঙ্গে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের অক্সিজেন যন্ত্রে গোলযোগ দেখা না দিলে আজ হয়তো তাঁদের নিয়েই হইচই হত। তাঁরা ফিরে আসেন এভারেস্ট চূড়ার তিনশো ফুট নীচে থেকে।
এডমণ্ড হিলারি, নিউজিল্যাণ্ডের এক মৌমাছিপালক। তেনজিং নোরগে, তিব্বতের মানুষ, নেপালে বসবাস (পরে ভারতের নাগরিক), এভারেস্ট অভিযানে সাহেবদের সঙ্গী। কী অদ্ভূত যোগাযোগে দুই গোলার্ধের দুজন সেদিন পৃথিবীর চূড়ায় কয়েক ফুট চওড়া একটা বরফের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন!
ব্রিটিশ অভিযানে নিউজিল্যাণ্ডবাসী হিলারি ঢুকেছিলেন এরিক শিপটনের জোরাজুরিতে। এভারেস্টের তত্ত্বতালাশ করতে ১৯৫১র অভিযানেও হিলারি ছিলেন। ওদিকে তেনজিং তারও প্রায় চোদ্দো বছর আগে থেকে এভারেস্ট অভিযানে যোগ দিচ্ছেন মালবাহক হিসেবে। এবার ওয়েস্টার্ন কুম-এ (‘কুম’, ওয়েল্শ্ ভাষার একটি শব্দ, অর্থ : উপত্যকা) একটা ভয়াবহ তুষারখাদ থেকে হিলারিকে বাঁচিয়েছিলেন তেনজিং। দুজনের মধ্যে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
হিলারিদের পথে খুব বিপজ্জনক ছিল ফেটে চৌচির বরফের থামে ভরা হিমবাহ-চত্বর— খুম্বু আইসফল। পেরলেন তাঁরা। পেরলেন ওয়েস্টার্ন কুম, পেরলেন তরতরে বরফের প্রাচীরের মতো লোৎসে পর্বতের পিঠ। পৌঁছলেন সাউথ কল-এ। সেখান থেকে শেষ অভিযান শৃঙ্গের দিকে। ২৬ মে বিফল হয়ে ফিরলেন ইভান্স ও বোর্ডিলন। শেষ অবধি, ২৯ মে, শৃঙ্গের পথে তেনজিংকে সঙ্গী করে চললেন হিলারি। অনেকটা ওঠার পর পথ জুড়ে দাঁড়াল ৪০ ফুট খাড়া একটা পাথুরে নাক— যেটা হিলারির মতে, আর একটু নীচের দিকে হলে শৈলারোহণ করে একটা বিকেল কাটানোর জন্য বেশ ভাল জায়গা হত, কিন্তু ওই উচ্চতায় প্রায় হ্যাঁ-কে না বলে দেবার মতো কঠিন। খুব ধীরে, একটু ঝুঁকি নিয়েই, সেই বাধাও কাটিয়ে উঠে এলেন হিলারি। দড়ি ধরে উঠতে সাহায্য করলেন তেনজিংকে। দুজনেই তখন সহ্যের শেষ সীমায়। কিন্তু তখনই তাঁর মনে হল সামনের কোনও বাধাই বোধহয় আর তাদের ঠেকাতে পারবে না।
পথ তবু ফুরয় না। একটা ক্লান্ত পা ফেলা, আবার পা তোলা, নিয়ে ফেলা আর একটু সামনে। কোনওমতে শরীর টেনে নিয়ে চলা। এক সময় হঠাৎই, হিলারি দেখলেন যে-গিরিশিরার ওপর তাঁরা দাঁড়িয়ে, তা আর উঠছে না, এবার নেমে যাচ্ছে। ডানদিকে তাকালেন। একটা খড়ের গাদার মতো উঁচু একটা বরফের ঢিবি। এই তবে চূড়া! কিন্তু ওটা কি একটা ঝুলন্ত কার্নিশ?— ভাবলেন হিলারি, পা দিলেই ভেঙে পড়বে! তাই যদি হয়, তবে পৃথিবীর চূড়ায় আর যেই দাঁড়াক বাবা, আমি নেই। কয়েকবার গাঁইতি ঠুকে, নিশ্চিন্ত হয়ে, তবে পা বাড়ানো।
এতক্ষণ একটানা চলার মাঝখানে প্রচণ্ড ক্লান্তি আর অবসাদের মধ্যেও একবার পথের দিকে, একবার তেনজিং-এর অক্সিজেন বোতলের দিকে নজর রাখতে হচ্ছিল হিলারিকে। তেনজিং এসব যন্ত্রের কিছুই বুঝতেন না। ক্যামেরায় ছবি তোলার কায়দাও জানা ছিল না তেনজিং-এর, কিন্তু, হিলারি পরে লিখেছিলেন, এভারেস্টের চূড়া ফোটোগ্রাফির ক্লাস নেওয়ার পক্ষে তেমন ভাল জায়গা নয়। তাই ওখানে দাঁড়ানো অবস্থায় তেনজিং-এর ছবি থাকলেও হিলারি সেখানে অনুপস্থিত।
বরফে একটা ছোট গর্ত করে তেনজিং এই শৃঙ্গের অধিষ্ঠাতা দেবতার উদ্দেশে কিছু নৈবেদ্য রাখলেন। একটা চকোলেটের বার, কয়েকটা বিস্কুট, এক গোছা ললিপপ। আর? আর তার মেয়ের দেওয়া একটা ছোট্ট নীল পেনসিল। হিলারি তার পাশে রাখলেন জন হান্টের হাত দিয়ে পাঠানো এক ব্যক্তির একটা ছোট্ট ক্রুশকাঠ। তার পর আর পিছন ফেরা নয়।
ওঁরা নেমে এসেছেন আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল।
আজ পর্বত অভিযানের সামগ্রী অনেক উন্নত হয়েছে। পাহাড়ে মানুষের শরীরের চালচলন নিয়ে জানা গেছে অনেক কিছু, যাতে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। সে সময় জন হান্টের দলটিকে প্রতিটা জিনিস নিজেদের মতো করে নিতে হয়েছিল, হিমালয়ে আসার আগে নিউজিল্যাণ্ড কি আল্পসেই সেসব পরীক্ষা করেছিলেন তাঁরা। সাউথ কল থেকে রওনা দেবার দিন ভোরে হিলারি দেখেন তাঁর জুতো আর পায়ে গলাবার অবস্থায় নেই। ঠাণ্ডায় জমে তা লোহা হয়ে রয়েছে। অগত্যা জুতোজোড়া সটান প্রাইমাস স্টোভের ওপর চাপিয়ে দিলেন হিলারি। পাক্কা এক ঘণ্টা আগুনে সেঁকার পর পোড়া চামড়া আর রবারের গন্ধে তাঁবুর বাতাস ঘুলিয়ে তুলে তা ধাতস্থ হল। এসব এখন ভাবা যায় না। এখন দাম দিলে এভারেস্ট মূল শিবিরে পাঁচ তারা হোটেলের ব্যবস্থায় থাকা যায়, স্যাটেলাইট টিভিতে দুনিয়ার খবর পাওয়া যায়, পড়া ও শোনার জন্য আস্ত লাইব্রেরিই প্রায় তুলে আনা হয় বই, ক্যাসেট, সিডি সমেত। হ্যাঁ, এভারেস্টে জঞ্জালও জমেছে ১০০ টন। দড়ি-দড়া, মই, বাতিল অক্সিজেনের বোতল ছাড়াও এখানে ওখানে রয়েছে আজও অবিকৃত নানা মানুষের মৃতদেহ। সেসব সাফ করাও এক রাজসূয় ব্যাপার।
এরই মধ্যে এভারেস্টে ওঠার জন্য লম্বা লাইন পড়ছে। রাধানাথ শিকদার এর উচ্চতা মেপেছিলেন ২৯০০২ ফুট, এখন অত্যাধুনিক উপায়ে শুধরে মাপ দাঁড়িয়েছে ২৯০২৮ ফুট। কিন্তু এটাই শেষ নয়, প্রতি মুহূর্তে হিমালয় তিল তিল করে ঠেলে উঠছে। এভারেস্টেরও উচ্চতায় বাড়ছে প্রতি বছর কয়েক মিলিমিটার করে। প্রতিবার এভারেস্টে ওঠাও তাই এক হিসাবে এক একটা নতুন রেকর্ড।