বাংলার হারিয়ে যেতে বসা লোকায়ত গান [ পর্ব ৩ ]

বাংলা সাহিত্বে এক বিশাল অংশ জুরে রয়েছে বাংলার লোকসাহিত্ব ও  লোকায়ত গানগুলী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে এগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গর্ভে। আমি তাই চেস্টা করেছি বাংলার এসব হারিয়ে যেতে বসা লোকসাহিত্ব্য ও লোকগিতীগুলো সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার। সেই ধারাবাহিকতায় আজ থাকবে তার তৃতীয় পর্ব।

১.
মারবেন না মারবেন না মাস্টার নয়নকে,
নয়নকে মারলে প্রাণে লাগে ব্যথা।
আমায় মারিলে নয়ন পাবে ব্যথা,
মারবেন না মারবেন না নয়নকে।

পিতা জানতে পারলে আমাকে ছাড়বে না,
দুইজন আমরা একই সাথে,
চইল্যা যাব গভীর রাতে,
আকাশে চাঁদ সূর্য সাক্ষী রেখে,
পিতা-মাতাকে ছাড়িয়া,
চলেছি, পিতা যেন জানেন না,
ইতি আমরা। তুমি আমি দুইজনা।

তুমি আমায় ভুলিয়া যাও না,
ভাই ছাড়লাম বোন ছাড়লাম,
তোমার প্রেমে মজিলাম।
ইতি আমরা দুইজনা।

( খুঁটি পোঁতার সারিগান )

২.
ও সোহাগী ননদিনী, নীলম্বরী পরবি?
খোঁপায় সাধের গেঁদা-ফুলের পেরজাপতি ধরবি?
হায়-হায়-হারে পরনে নাই টেনা,
ভাসুর ঠাকুর আঙ্গনেতে ছিঁড়া-কাঁথাটা দেনা।।
সরম ধরম রইবে কুথায় বিবির হাটে যাব-
কনডোলেতে নাইন দিয়ে চাল মাগিয়ে খাব।।
কনডোলেতে চাল নাইরে,
কপালে মার ঝাঁটা
পথের পাশে মানুষ মরে
কুকুর-বিড়াল-পাঁঠা।।

( ভাদু গান )

৩.
না যান, না যান, না যান মাহুত রে,
মাহুত বাড়িতে বহেন রে হাল।
ভালে না হয় হাতীর চাকিরি, সাথে সাথে কাল।।

বাপো ভাইয়ে নাই শিখায় কইন্যা রে, হালো বহিবারে।
কেনং থাকিমো কইন্যা, তোমার বাসরে।।

না কান্দো, না কান্দো কইন্যা কইন্যা হে, ভাঙ্গিবে অসের গালা।
খোদায় যদি ফিরিয়া আনে, সোনায় বন্দিম গালা।।

তোরষা নদীর পারে পারে রে মাহুত, তোমরা চরন হাতী।
তুই মাহুতের গুণো শুনিয়া আমরা দিলাম জাতি।।

জাতি দিনু কুলো দিনো রে মাহুত, তোমার নাগিয়া।
এলায় কেনে ছাড়িয়া যাচ্ছেন নিদয়া হইয়া।।

ছয়ো মাসো থাকো কইন্যা হে, বাপে ভাইয়ের ঘরে।।
ফিরিয়া আসিমো কইন্যা হে ছয়ো মাসো পরে।।

(ভাওয়াইয়া, রংপুর)

৩.
নাও বাইচ দেইখা কার ঝিয়ারী
ভাছকি ভুছকি পারে।
উই যে দ্যাখ বেড়া ভাইঙ্গা
কেমনে ফুচকি পারে।।
মন দিও না,মন দিও না, সোনার বাইচালে।।

আমরা তো ভাই বাইচের মাঝি,
দ্যাশে দ্যাশে ঘুরি।
একলা একলা থাইকপা ঘরে
পীরিত আগুনে পুড়ি রে।।
মন দিও না,মন দিও না, সোনার বাইচালে।।

চর দ্যাশের বাইচাল আমরা চইরা বইরা খাই।
গরীব গরীব মানুষ আমরা,
জাগা-জমিন নাই রে।।
মন দিও না,মন দিও না, সোনার বাইচালে।।

আমরা হইলাম জাত বাইচাল,
নদীর পানিত বাসা।
বাইচাল দেইখা মন দিলি কন্যা
তোমার হইবে সর্বনাশা রে।
মন দিও না,মন দিও না, সোনার বাইচালে।।

তুমি তো কন্যা গেরস্থের মাইয়া
আছও মহাসুখে।
বাইচাল দেইহা পীরিত করিলে
যাইব জীবন দু:খে রে।।
নাও বাইচ দেইখা কার ঝিয়ারী
ভাছকি ভুছকি পারে।
উই সে দ্যাখ বেড়া ভইঙ্গা
কেমন ফুচকি পারে।।

(নৌকা বাইচের সারি গান, পাবনা)

৪.
কেমনে পোহাইব রজনী, ও প্রাণের বন্ধু রে,
কেমনে পোহাইব রজনী।।
বন্ধু রে, যয়বনে পীরিত মিঠা,
পান মিঠা চুনে।
তোমার সাথে প্রেম করিয়া
অন্তর কাটে ঘুণে।।
বন্ধুরে, অস্ত যখন যায় রে ভানু,
আনন্দ হয় মনে।
অভাগিনীর দু:খের নিশা
আসে রে সামনে।।
বন্ধু রে, সিঁথির সিন্দুর, নাকের বেসর
কে দেখবে নয়নে।
কখন উথি, কখন লুটি,
নিশি জাগরণে।।
বন্ধু রে, বসন্তে ভোমরার আসে
ফুল ফুটে বনে।
আমার যয়বন কলি আফোট রইল,
তুই বন্ধুর বিহনে।।

(ভাটিয়ালী, ময়মনসিংহ)

৫.
কি আশায় ফকির হলি রে মন,
সে কথা বল শুনি।
রংমহল কোঠা রেখে মদনের বাধ্য তুমি।
ও তার ধর্মকর্ম সব গিয়েছে
কেবল হাওয়া বদ শুনি।।
হাওয়ার আসা, হাওয়ার যাওয়া
হাওয়ার খবর কেউ করলে না।
বার মাসের এই কারখানা
মনের মানুষ কেউ চিনলে না।।
ফকির চাঁদ দরবেশে বলে,
হাওয়া ধরা গেল না রে।
যদি কেহ ধরতে পারে আপনার শক্তি জোরে।।
আবের পর আতসের গরমে
তার উপরে আবের মোকাম
তার উপরে চলছে হাওয়া
তিন তারে করা মিলন।
কি করবে তার শ্মশান-শমন।।

(দরবেশী গান, ফকির চাঁদ)

https://www.facebook.com/l.php?fb_ref=homepage