আর হাতে থাকে একটা আয়না, তবে তাতে কীসের ছবি পড়বে? পনেরো বছর বয়সেই এমন সব প্রশ্ন ঘুরত আইনস্টাইনের মাথায়।
১৯০৫ সালটা ছিল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এক অবাক-করা বছর, বা annus mirabilis। ওই বছরে পরপর ছাপা হয়ে বেরোয় তাঁর কয়েকটি গবেষণাপত্র, যাতে তিনি ‘স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই থিওরি দেখিয়ে দিল, দূরত্ব (space) অথবা সময়ের (time) কোনও চরম বা সুনিশ্চিত (absolute) মাপজোক নেই।
সেই অবাক-করা বছরে আইনস্টাইনের বয়স ছিল ২৫ বছর। কিন্তু এই থিওরি যে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়, সেগুলো তাঁর মাথায় এসেছিল যখন তাঁর বয়স পনেরো কি ষোলো। আলোর গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যদি ছুটতে পারতাম তা হলে কী হত? আর ওই গতিতে ছোটার সময় হাতে আয়না থাকলে তাতে কীসের প্রতিচ্ছবি পড়ত? দোলনায় দুলতে দুলতে লাফিয়ে পড়লে শরীরটা হঠাৎ হালকা হয়ে যায় কেন?
Special Theory of Relativity
অথচ ছেলেবেলায় অ্যালবার্টকে সবাই ‘পিছিয়ে-পড়া’ ছেলে বলেই জানত। শিশু অ্যালবার্টের কথা ফুটেছিল একটু দেরিতে। স্বভাব ছিল ভারী লাজুক। থেমে থেমে চিন্তা করে কথা বলত। অ্যালবার্টের যখন চার-পাঁঁচ বছর বয়স, তখন তাঁর ইঞ্জিনিয়ার কাকা জেকব তাঁকে একটা চুম্বক কম্পাস উপহার দেন। তাই নিয়ে কত চিন্তায় তাঁর শিশুমন তোলপাড় হয়। আরও পরে ইউক্লিডিয় জ্যামিতির একটা বই হাতে পেয়ে বুঝতে শেখেন, অঙ্কের একটা সৌন্দর্য আছে।
ছেলেবেলা থেকেই আইনস্টাইনের অঙ্কের মাথা খুব পরিষ্কার ছিল। কিন্তু তখনকার জার্মান স্কুলগুলিতে মুখস্থবিদ্যা ও পুঁথিগত বিদ্যার উপর অযথা জোর দেওয়া হত। তাই ইস্কুলে তাঁর একঘেয়ে, পানসে লাগত। দিদিমণিরাও তাঁকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। অাইনস্টাইনের শিক্ষার ভিত গড়ে ওঠে বাড়িতেই। কাকা জেকবের প্রভাবে অ্যালবার্ট গণিত, পদার্থবিদ্যা ও দর্শন ভালবাসতে শেখে। যে বয়সে ছেলেরা খেলাধুলো, গান-সিনেমা নিয়ে মেতে থাকে, তখন থেকেই অ্যালবার্ট গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয়গুলি নিয়ে মনে নানা জটিল ধাঁধা বা thought experiment তৈরি করা শুরু করেন। ষোলো বছর বয়সের এমনই একটি ধাঁধা তাঁকে আলোর গতিবেগকে ফাঁকি দিয়ে time travel-এর আইডিয়া দেয়। এই আইডিয়াটা আপাতদৃষ্টিতে কিন্তু খুব একটা কঠিন নয়। ইচ্ছা করলে তোমরাও আইনস্টাইনের মতো ভাবতে পারো। এসো ধাঁধাটি নিয়ে তিনটি ধাপে এগনো যাক।
যে কখনও ভুল করেনি, সে কখনও
নতুন কিছু করার চেষ্টা করেনি
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
ধরো তুমি এমন একটা ট্রেনে চেপে যাচ্ছ যার গতি ঘণ্টায় ৫০ মাইল। এ বার ট্রেনটি যে দিকে চলছে সে দিকেই একটা বল ছুড়ে দিলে। ট্রেন ও তোমার সাপেক্ষে বলটি ঘণ্টায় ২০ মাইল বেগে উড়ে গেল। এ বার বলো তো, রেললাইনের ধারে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোক বলটিকে কত গতিবেগে উড়তে দেখবে? ৫০, ২০, নাকি ৭০ মাইল বেগে? তৃতীয়টা ঠিক। ট্রেন ও বলের গতিবেগের যোগফলটিই উত্তর।
দ্বিতীয় ধাঁধার বেলায় অ্যালবার্ট একটু হোঁচট খেলেন। তিনি শুনেছিলেন যে সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানীরা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে আলোর গতিবেগ সেকেণ্ডে ১,৮৬০০০ মাইল। তারা এ-ও দেখিয়েছিলেন যে আলোর এই গতি সব পরিস্থিতিতেই একই— আলোর উৎস বা যে দেখছে সে স্থান পরিবর্তন করলেও। দ্বিতীয় ধাঁধা অত্যন্ত দ্রুতগতির কাল্পনিক ট্রেনকে কেন্দ্র করে। ধরো ট্রেনটির গতি আলোর গতির ঠিক অর্ধেক (সেকেণ্ডে ৯৩,০০০ মাইল)। এ বার বলের পরিবর্তে একটা টর্চ জ্বালালে রেললাইনের পাশে দাঁড়ানো লোকটির চোখে আলোর গতিবেগ কত হবে? ৯৩,০০০; ১,৮৬০০০ নাকি ২,৭৯০০০ মাইল বেগে? জেমস ম্যাক্সওয়েলের মতো বিজ্ঞানী যে পরীক্ষা করে বলেছিলেন, দ্বিতীয়টিই ঠিক উত্তর। কিন্তু আইনস্টাইনের মনে খটকা লেগেছিল। আলোর উৎস এত জোরে ছুটছে, অথচ আলোর গতি স্থির থাকছে কী করে?
তৃতীয় thought experiment-টার ফল অ্যালবার্টের মনের খটকাটাকে জোরদার করল। এটি দ্বিতীয় ধাঁধাটির মতোই, তবে এতে ছোট্ট একটা প্যাঁচ আছে। ধরো ওই একই গতির (৯৩,০০০ মাইল) ট্রেনে আবার টর্চ জ্বাললে। এ বার তোমার কাছে ওই ছুটন্ত অবস্থাতে আলোর গতি কত হবে? নিউটনের ফিজিক্সের ধারণার অনুসরণ করলে সেকেণ্ডে ১,৮৬০০০ মাইল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ট্রেনের ভিতরের অতি দ্রুত ধাবমান যাত্রীর কাছে আর রেললাইনের ধারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির কাছে কী করে আলোর গতি একই হয়? এই বিচিত্র স্ববিরোধী ধাঁধাই বালক অ্যালবার্টকে কুরে কুরে খেতে লাগল। আর এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আইনস্টাইন শেষ অবধি প্রমাণ করেছিলেন, নিউটন আর ম্যাক্সওয়েল, দুজনেই ভুল। গতির কোনও চরম সংজ্ঞা নেই, সময়েরও কোনও নির্দিষ্ট মাপ নেই।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৬ চৈত্র ১৪১১ রবিবার ২০ মার্চ ২০০৫