লটারির টাকায় কলকাতা
হীরেন ঘোষ
সে অনেককাল আগের কথা। তখন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজত্বকাল। কলকাতায় সেন্ট জন গির্জা তৈরি করা হবে। করা তো হবে কিন্তু অর্থের যে বড় অভাব। সে অভাব মিটবে কেমন করে? অনেক ভাবনাচিন্তার পরে ব্যবস্থাপকদের মাথায় এক নতুন পরিকল্পনার উদয় হল। লটারির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করলে কেমন হয়? ভাবনামতো কাজ শুরু হল। লটারির আয়োজন করতে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গির্জা তৈরির অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৭৮৪ সালে কলকাতায় প্রথম লটারি অনুষ্ঠিত হল। সেই লটারি থেকে গির্জা তৈরির তহবিলে জমা পড়ল পঁচিশ হাজার ছয়শো টাকা।
এখন তো ‘লটারি’ শব্দটা কানে এলে ছোটবড় সকলে নড়েচড়ে বসি। পুরস্কারের অঙ্ক নিয়ে ভাবতে বসি। কখনও কখনও কোন পাড়ার কোন ক্লাব কত কম দামের টিকিটে বেশি মূল্যের পুরস্কার দিচ্ছে তার একটা তুলনামূলক আলোচনাও হয়ে থাকে। আজ থেকে দুশো বছরেরও আগে অনুষ্ঠিত প্রথম লটারিতে কলকাতাবাসীবৃন্দ যেমন সাড়া দিয়েছিলেন আজও লটারির নামে সেই সাড়ায় কোনও ঘাটতি পড়েনি।
নতুন, চমক লাগানো, আশা-নিরাশার দোলায় দোলা, পাব কি পাব না-র ঢেউয়ে নাচানাচির এই লটারি প্রথম চেষ্টাতেই কলকাতার মানুষদের মন টেনেছিল। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উত্তেজনা ও আলোড়ন তুলেছিল। লটারির নানাবিধ কাজকর্ম, যেমন টিকিট ছাপানো, বিক্রি করা, পুরস্কার নির্বাচন ও প্রদানের ব্যবস্থা, লটারি অনুষ্ঠিত করা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ কাজকর্মগুলো যাতে করে সুচারুরূপে ও সঠিক এবং নির্ভুল ভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য একটি ‘লটারি কমিটি’ তৈরি করা হয়েছিল। সেই কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল নয় এবং তাঁদের বলা হত কমিশনার। এই লটারি কমিটির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন লটারি অনুষ্ঠিত হত।
কলকাতা শহরের নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণে অর্থ সংগ্রহের একটি বিশেষ উপায় ছিল লটারি। এই শহরের পথঘাট তৈরি, নগরের নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজে সেই সময় থেকেই লটারি একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল।
১৭৯৫ সালে গভর্নর জেনারেলকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে কলকাতায় একটি ‘চ্যারিটেবল ফাণ্ড’ চালু হয়েছিল। কলকাতায় লটারি জনপ্রিয় হওয়ায় অর্থ সংগ্রহের একটি নতুন পথ পরিচালকদের সামনে খুলে গিয়েছিল। লটারির মাধ্যমে যে অর্থ এই ফাণ্ডে সংগৃহীত হত, কলকাতার গরিব খ্রিস্টানদের ভিতর বড়দিন, গুড ফ্রাইডে প্রভৃতি উৎসবের দিনে নিয়মিত ভাবে সেই অর্থ সাহায্য হিসাবে দেওয়া হত। পরের দিকে এর নাম বদলে নতুন নাম হয়েছিল ‘ডিষ্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল ফাণ্ড’।
সেই সময়ে কলকাতায় এ দেশীয়দের চিকিৎসার জন্য কোনও হাসপাতাল ছিল না। একমাত্র হাসপাতাল, প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতাল, তখন কলকাতায় ছিল এবং এই হাসপাতালে শুধুমাত্র ইংরেজ সৈন্য ও ইংরেজ নরনারীদেরই চিকিৎসা হত। কলকাতার কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ইংরেজ রাজকর্মচারী এ দেশীয়দের জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৯৩ সালে এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি লটারির আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু লটারি করে যে অর্থ পাওয়া গিয়েছিল, তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে অর্থ গ্রহণ করেননি।
কলকাতা শহরের নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজে লটারি করে অর্থ সংগ্রহ তখন বেশ চালু হয়ে গিয়েছে। ১৭৮৯ সালে শহরে ‘এক্সচেঞ্জ হাউস’ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? কেন, লটারি আছে না? ব্যবস্থা হল লটারির। সে এক হইহই ব্যাপার। সাধারণ মানুষ যেমন উৎসাহী হয়ে টিকিট কিনেছিলেন, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণও বাদ যাননি। এমনকী, গির্জার পাদ্রি সাহেবরাও লটারির টিকিট কেনায় পিছিয়ে থাকেননি। আজকের কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘টাউন হল’ তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল ১৮০৫ সালে। সঙ্গে লেজুড় হয়ে দেখা দিল অর্থ সমস্যা। টাকা কোথায়? আবার সেই সর্ব সমস্যাহরণকারী লটারি। অর্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
কলকাতা শহরের এই সকল ভাল ভাল কাজে লটারি কমিশনের সাহায্য ও সহযোগিতায় সন্তুষ্ট হয়ে সরকার লটারি কমিশনকে স্বীকৃতি দিয়ে টাউন হল তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লটারির আয়োজন করার সরকারি অনুমতি দিলেন। প্রথম বার মোট ৫ লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি করা হল। এর মধ্যে এক হাজার টিকিটের জন্য পুরস্কারের বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু টাউন হল তৈরির জন্য যে পরিমাণ অর্থ লটারির মাধ্যমে সংগৃহীত হবে বলে ধরা হয়েছিল, তা না হওয়ায় পরে আরও তিন বার লটারি করা হয়। চতুর্থ বারের লটারি থেকে পুরস্কার ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে মোট লাভ হয়েছিল পঁচাত্তর হাজার টাকা। এই ভাবে একাধিক বার লটারি করে টাউন হলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১৮১৩ সালে টাউন হল সম্পূর্ণ হয়।
এই সময় কলকাতায় ‘শহর উন্নয়ন কমিটি’ নামে একটি সংস্থা ছিল। শহরের নানা রকম উন্নতির জন্য প্রয়োজনে লটারি করে টাকা জোগাড় করার অনুমতি এই কমিটিকে দেওয়া হয়েছিল। ১৮০৫ থেকে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত নানা সময়ে এই কমিটি লটারির আয়োজন করেছিল। সেই অর্থে কলকাতার নানা পথঘাট, কিছু সরকারি বাড়ি, পার্ক, নালা-নর্দমা, পুকুর খনন ও মজা পুকুর ভরাট করে অনেক কাজ করেছিল। ১৮০৯ সালে কলকাতার সার্বিক উন্নয়ন উপলক্ষে একটি বড় আকারের লটারির আয়োজন করা হয়েছিল। সেই লটারির প্রথম পুরস্কার ছিল তখনকার দিনের এক লক্ষ টাকা।
আগেকার সব কমিটির বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৮১৭ সালে সরকার একটি স্থায়ী লটারি কমিটি তৈরি করল। পূর্বেকার কমিটি থেকে এই কমিটি প্রায় চার লক্ষ টাকা হাতে পায়। এই টাকাও কলকাতার উন্নয়নে খরচ করা হয়েছিল। এখনকার অনেক বড় বড় রাস্তা যেমন ষ্ট্র্যাণ্ড রোড, হেয়ার ষ্ট্রিট, কলেজ ষ্ট্রিট, ওয়েলেসলি ষ্ট্রিট, কলুটোলা ষ্ট্রিট প্রভৃতি রাস্তা তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণ ও আরও অনেক কাঁচা রাস্তা পাকা করা হয়েছে লটারি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।
কলকাতায় তখন অন্য আর এক ধরনের লটারিরও প্রচলন হয়েছিল। বহু মানুষ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রয়ের পথ হিসাবে লটারির সাহায্য নিত। নানা রকম আসবাবপত্র, শৌখিন দ্রব্যাদি, মূল্যবান বইপত্র, দামিদামি ছবি এই সকল ব্যক্তিগত লটারিতে পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হত। অল্প পয়সায় টিকিট কিনে দামি জিনিস পুরস্কারের আশায় বহু মানুষ টিকিট কিনত। কলকাতার লটারির এই রমরমা সময়ে স্টুয়ার্ট কোম্পানি একটি লটারির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, ‘বিলাত হইতে আমরা একখানি অতি সুন্দর কারুকার্য খোদিত বহুমূল্য কোচগাড়ি আমদানি করিয়াছি। ইহা চারি ঘোড়ায় টানিবার উপযুক্ত। গাড়ি ও ঘোড়ার সাজের মূল্য ছয় হাজার টাকা। প্রত্যেক টিকিটের মূল্য দুই শত টাকা।’
বহুদিন ধরে এই ভাবে লটারির টাকায় শহরের নানা উন্নতি হলেও ১৮৩৬ সালে শহর উন্নয়নের জন্য লটারি করে টাকা সংগ্রহ বন্ধ করা হল। ততদিনে খোদ ইংল্যাণ্ডে কলকাতার লটারি তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছিল। এই পন্থায় অর্থ সংগ্রহ ইংল্যাণ্ডের বড়কর্তাদের পছন্দ হল না। সেখানে লটারির বিরুদ্ধেও প্রবল জনমত গড়ে উঠল। জনসাধারণের সমালোচনায় ও চাপে কলকাতায় স্থায়ী ভাবে লটারি কমিটির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হল।
দীর্ঘদিন লটারি কমিটি কলকাতার নানা উন্নতিতে সাহায্য করে ১৮৩৬ সালে অবলুপ্ত হয়ে গেল। অবলুপ্ত হলেও লটারি কমিটিকে কিন্তু কলকাতা কোনও দিন ভুলতে পারবে না।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৬ বৈশাখ ১৪১০ রবিবার ২০ এপ্রিল ২০০৩