সাত মৃত্যু এবং একটি গুজব_অমিতাভ গুপ্ত _DEATH OF SEVEN AND GOSSIP

সাত মৃত্যু এবং একটি গুজব
অমিতাভ গুপ্ত 

মিশরের ফারাও তুতানখামেনের সমাধিতে ঢুকেছিলেন লর্ড কার্নারভন।  মাসখানেক পরে, ১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল মারা গেলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর সময়ে হাসপাতালে আলো চলে যায়। সবাই বলল, এ নিশ্চয়ই মমির অভিশাপ। বিজ্ঞানীরা বললেন, নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছেন কার্নারভন। আর লোডশেডিং প্রায়ই হত কায়রো শহরে। অভিশাপ আবার কী?

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ। অষ্ট্রেলিয়ায় মারা গেলেন মলিকিউলার বায়োলজির গবেষক টম লয়। মৃত্যুর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। গত বছর আল্পস পর্বতমালায় তুষারঝড়ে মারা গেলেন পর্বতারোহী হেলমুট সাইমন। আট দিন পরে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান উদ্ধারকারী দলের প্রধান। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর।

lord carnarvon
Lord Carnarvon

রাইনার হেন ছিলেন ফরেনসিক প্যাথোলজিস্ট। ১৯৯২ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। পর্বতারোহী কার্ট ফ্রিৎস একটি বিশেষ অভিযানে রাইনার হেনকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় বরফের ধ্বসে চাপা পড়ে। রাইনার হোলজ্‌ তথ্যচিত্র বানাতেন। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নৃতত্ত্ববিদ কনরাড স্পিণ্ডলার ৬৬ বছর বয়েসে মারা যান লিভারের অসুখে।

হঠাৎ এই মানুষগুলির মৃত্যুর খবর কেন? তার কারণ, গোটা বিশ্বে এই সাতটি মৃত্যু নিয়ে চলছে ফিসফাস, কানাকানি। মমির অভিশাপ কি সত্যিই রয়েছে? নইলে আল্পস পর্বত থেকে ‘আইসম্যানকে’ উদ্ধার করেছিলেন যারা, তারা কেন এক এক করে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন?

১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হেলমুট ও এরিকা সাইমন নামের দুজন শখের পর্বতারোহী আল্পস পর্বতমালায় গিয়েছেন। এক দিন পাহাড় থেকে নামার পথে দিক ভুল হয়ে গেল তাঁদের। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলেন একেবারে অচেনা জায়াগায়। সেটা শান্ত এক তুষারক্ষেত্র। আন্দাজে এগোতে এগোতে চোখে পড়ল, বরফের ওপর কে যেন একটা পুতুল ফেলে গিয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলেন, পুতুল নয়, বরফে গেঁথে যাওয়া একটি দেহ। যে পাহাড়ে মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, সেটা অষ্ট্রিয়া আর ইতালির ঠিক মাঝখানে। তাই, খবর পাঠানো হল দু দেশের পর্বত সুরক্ষাবাহিনীর কাছেই। ইতালির লোকেরা গা করলেন না, কিন্তু অষ্ট্রিয়া থেকে হেলিকপ্টারে চেপে উদ্ধারকারী দল এল। ক্যামেরা নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে চলে এলেন রাইনার হোলজ্‌। ততক্ষণে মৃতদেহটির একটা নামকরণও হয়েছে— আইসম্যান বা তুষারমানব।

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, হয়তো নিখোঁজ কোনও পর্বতারোহীর দেহ ওটা। কিন্তু তুষারমানবের চার পাশে খুঁজে পাওয়া যেতে লাগল একটার পর একটা অদ্ভুত জিনিস— কিছু কাঠের টুকরো, তীর-ভরা তূনীর, একটা এমন তুষারকুঠার, যা এ যুগের কোনও পর্বতারোহী ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারেন না। ক্রমশ মনে হতে থাকল, তুষারমানব বোধ হয় বেশ কিছু দিন আগের মানুষ। চার-পাঁচ দিনের চেষ্টায় বরফ থেকে সম্পূর্ণ বার করা গেল তুষারমানবকে। দেখা গেল, তার শরীরের প্রায় সব অংশই অক্ষত। পরনের পোশাক ঠিক আছে, এক পায়ে জুতোও পরা। পোশাক, জুতো এ সব দেখে আরও বেশি মনে হতে থাকল, হয়তো কয়েকশো নয়, কয়েক হাজার বছর আগেকার মানুষ সে। হেলিকপ্টার তুষারমানবকে নিয়ে চলে গেল অষ্ট্রিয়ার ভেন্ট শহরে। সেখানে ফরেনসিক প্যাথোলজিস্ট রাইনার হেন, আর মলিকিউলার বায়োলজিস্ট টম লয় পরীক্ষা করেন তুষারমানবকে।

পরীক্ষা করে জানা গেল, বয়সটা একটু বেশিই বটে—৫৩০০ বছর! মানে, বোঞ্জ যুগের মানুষ সে। বিজ্ঞানীরা বললেন, তার চুলে অতিরিক্ত তামা আর আর্সেনিক রয়েছে। মনে হয় কোনও তামার খনিতে কাজ করত সে। তার বয়সও পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়েছিল, মানে সে যুগের হিসেবে সে বুড়ো হয়ে গিয়েছিল।

https://forum.banglalibrary.org/extensions/image_upload/images/1282584087.gif
Lord Carnarvon and Howard Carter boasted proudly about their discovery

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, তুষারমানব বোধহয় ঠাণ্ডা আর খিদেয় মারা গিয়েছিল। কিন্তু ডি এন এ পরীক্ষায় সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তুষারমানবের কাঁধের পিছন দিকে গেঁথে রয়েছে তীরের ফলা। বিজ্ঞানীরা ডি এন এ পরীক্ষা করে বললেন, তুষারমানবের ছুরি, কুঠার, তীরের ফলা, জামায় যে রক্তের ছিটে পাওয়া গিয়েছে, তা অন্যান্য মানুষের। যার মানে, মৃত্যুর আগে সে রীতিমত লড়াই করেছিল। আবার কোনও বিজ্ঞানী বলেছেন, হয়তো তাকে হত্যা করা হয়নি, বলি দেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের দেবতাদের কাছে। তার শরীরে পাওয়া গিয়েছে যে ফুলের রেণু, তা থেকে বোঝা যায় সে মারা গিয়েছিল বসন্তকালে, কিংবা গ্রীষ্মের গোড়ায়। তার জামা ছিল ছাগল আর হরিণের চামড়ার, আর গাছের ছালের তৈরি। টুপি ভালুকের চামড়ার। কুঠারে তামার ফলা। তার পেটে পাওয়া গিয়েছে হরিণের মাংস, গম, সব্জি আর ‘বেরি’ জাতীয় ফল। দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি একটা গর্তে তার দেহ পড়েছিল। তুষার চাপা পড়ে সেখানে একটা প্রাকৃতিক ‘ফ্রিজার’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই তুষারমানবের দেহ মমিতে পরিণত হয়েছে।

অনেকের বিশ্বাস, মমি নিয়ে নাড়াচাড়া করা খুব শুভ নয়, কারণ তাতে নাকি আত্মা অসন্তুষ্ট হয়, অভিশাপ দেয়। মমির অভিশাপ মানেই অস্বাভাবিক মৃত্যু। সুতরাং, সেই মমি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা, কাটাছেঁড়া করলে তার ফল ভাল হবে না। এর পর একে একে মারা যেতে থাকলেন উদ্ধারকারী দলের নেতা, নৃতত্ত্ববিদ কনরাড স্পিণ্ডলার, যিনি তুষারমানবের বয়স নির্ণয় করেছিলেন; প্যাথোলজিস্ট রাইনার হেন, আল্পস পর্বতমালায় তাঁর পথপ্রদর্শক কার্ট ফ্রিৎস, তথ্যচিত্র নির্মাতা রাইনার হোলজ্‌। কারও মৃত্যুই স্বাভাবিক ছিল না। গত বছর যখন হেলমুট সাইমন মারা যান সেই আল্পস্‌-এই, তখনই গুজব জোরদার হল আরও। আর, গত মাসে মলিকিউলার বায়োলজিস্ট টম লয় মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার উঠেছে প্রশ্নটা— সত্যিই কি মমির অভিশাপ আছে?

টম লয়ের ভাই গারেথ লয় উড়িয়ে দিয়েছেন কথাটা। বলেছেন, টমের স্বাস্থ্য এমনই ভাল ছিল না। গত ১২ বছর ধরেই রক্তের একটা রোগে ভুগছিলেন তিনি। মমির অভিশাপ নিয়ে কোনও দিন কথাই বলেননি দুই ভাই। টমের সহকর্মীরা বলেছেন, টম অভিশাপে বিশ্বাস করতেন না। মানুষের মারা যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। এমন গুজব বারবার ছড়িয়েছে, তা নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে, ফিল্ম বানানো হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বারবার এমন সব ধারণা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কাছে তুষারমানবের মতো মমি এক দুর্মূল্য সম্পদ, কারণ তা থেকে সে যুগের মানুষের জীবন সম্পর্কে এমন অনেক কথা জানা যায়, যা এত দিন কেবল কল্পনা করতে হয়েছে। তুষারমানবকে পাওয়া না গেলে কি জানা যেত যে, পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ ‘ট্যাটু’ বা উল্কি আঁকত নিজের গায়ে? তবে আজকের মতো ফ্যাশনের টানে তা আঁকত, না ধর্মবিশ্বাসের জন্য, নাকি চিকিৎসার জন্য, তা অবশ্য এখনও বোঝা যায়নি।

সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৪ অগ্রহায়ণ ১৪১২ রবিবার ২০ নভেম্বর ২০০৫

https://www.facebook.com/l.php?fb_ref=homepage