মহারাজ হবুচন্দ্রের রাজসভা। উঁচু সিংহাসনে বিশাল মুকুট পরে রাজা হবুচন্দ্র গম্ভীর মুখে বসে আছেন। পাশেই মন্ত্রী গবুচন্দ্রের আসন। তার পর অন্যান্য সভাসদ। সবাই যে যার জায়গায় চুপচাপ। কারণ রাজা হবুচন্দ্র চুপ। মন্ত্রী গবুচন্দ্র ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে রাজাকে দেখছেন। কিছু দিন আগেই জুতো আবিষ্কার হয়েছে। সবার পায়ে চকচকে সুন্দর জুতো।
কিন্তু গবুচন্দ্রের ভয় অন্য খানে। জুতো আবিষ্কারের সময় তার তো চাকরি যায় যায়। এক বুড়ো মুচি আর একটু হলেই তার চাকরিটা খাচ্ছিল। এখন আবার কী এমন সমস্যা যে রাজা হবুচন্দ্র এত গম্ভীর?
—নাঃ, এ জীবনে আর সুখ নেই। আমি খাওয়া-দাওয়া ছেড়েই দেব। অনেকক্ষণ পরে রাজা হবুচন্দ্র মুখ খুললেন। মন্ত্রী গবুচন্দ্র আর অন্যান্য সভাসদরা হই হই করে উঠলেন।
—কেন মহারাজ, আপনার কেন এত কষ্ট?
বেশি কথা না বললে মন্ত্রী গবুচন্দ্রের মান থাকে না।
—বুঝেছি মহারাজ, আজকে রাঁধুনি নিশ্চয়ই লবণ দিতে ভুলে গেছে। এই! কে আছো— যাও রাঁধুনিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও।
রাজা হবুচন্দ্র অত্যন্ত বিরক্ত মুখে গবুচন্দ্রের দিকে তাকালেন। ভুল বুঝতে পেরে গবুচন্দ্র ভয়ে ভয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন।
এক জন বয়স্ক সভাসদ উঠে দাঁড়ালেন— মহারাজ, আপনার জন্য আমরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। আপনি আহার ত্যাগ করলে আমরা সবাই অনশনে থাকব।
সেনাপতি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন— আপনার সমস্যাটা একটু বলুন মহারাজ। আমি এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়ব। বলতে বলতে খাপ থেকে তলোয়ার বের করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও তলোয়ার বের করতেই পারলেন না।
সেনাপতির অবস্থা দেখে গবুচন্দ্রের হাসি চাপা কঠিন হয়ে পড়ল। কিন্তু রাজা হবুচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন।
—গরম গরম লুচি আর তরকারি হল আমার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। কিন্তু পাকশালা থেকে নিয়ে আসতে আসতে একেবারে ঠাণ্ডা। নাঃ, তোমাদের দ্বারা কিস্সু হবে না। আমি খাওয়া-দাওয়া ছেড়েই দিলাম— বলতে বলতে রাজা হবুচন্দ্র চকচকে নতুন জুতো মসমসিয়ে অন্দরমহলে চলে গেলেন। রাজা হবুচন্দ্র চলে যেতেই মন্ত্রী গবুচন্দ্র গা-হাত ঝেড়ে তিড়িং-বিড়িং লাফাতে শুরু করলেন— তোমাদের দ্বারা কিস্সু হবে না। মহারাজ গরম গরম নুচি-তরকারি খেতে চান, সেটাও কেউ পারে না? সবাই শুধু ভাল সাজ করে সভা আলো করে বসে আছ, আর রাজকোষ থেকে গাদা গাদা টাকা নিচ্ছো শিগ্গির উপায় বের কর, নইলে সবার চাকরি যাবে। এক নিশ্বাসে চিৎকার করে গবুচন্দ্র আসনে বসলেন। সভাসদরা আলোচনা শুরু করলেন।
—রাজামশাইয়ের খাবার ঘরের পাশে নুচি-তরকারি রান্নার ব্যবস্থা করা হোক। তা হলে রাজামশাইকে গরম গরম খাওয়ানো যাবে।
ব্যস, সৈন্য-সামন্ত ছুটল, ঘোড়া ছুটল, লোক-লস্কর ছুটল। পরের দিন মণ মণ কাঠ রাজামশাইয়ে খাবার ঘরের পাশে জড়ো করা হল। উনুন তৈরি হল। জলখাবারের সময় নতুন উনুনে বসানো হল লুচি আর তরকারি। রান্নাও হল। কিন্তু রাজপ্রাসাদ কাঠের ধোঁয়ায় অন্ধকার। রাজা-রানি লুচি-তরকারি খাবেন কী, ধোঁয়ায় চোখের জলে নাকের জলে একাকার। মন্ত্রী গবুচন্দ্র আর অন্যান্য সভাসদদেরও একই অবস্থা। রাজা হবুচন্দ্র লুচি-তরকারির থালা ঠেলে ফেলে উঠে গেলেন। বললেন, সবাইকে শূলে চড়াও।
আবার সভা বসল। রাজা হবুচন্দ্র ছাড়া সবাই উপস্থিত। অনেক সভাসদ মাথা চুলকে চুলকে সব চুল উঠিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কোনও সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় একজন ময়রা রাজসভায় ঢুকল— মন্ত্রী মশাই, আমি পারব রাজামশাইকে গরম নুচি-তরকারি খাওয়াতে। আমাকে পাকশালে যাবার অনুমতি দিন। সভাসদরা হই চই করে উঠলেন— পাওয়া গেছে, সমাধান পাওয়া গেছে। সৈন্যরা দল বেঁধে সেই ময়রাকে পাকশালে নিয়ে গেল।
ময়রা ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে কাজ শুরু করল। লুচির ময়দার মধ্যে তরকারি ভরে দিয়ে ভাল করে মুড়ে নিল। তার পর লুচির মতো ঘিয়ে ভেজে রাজামশাইকে পরিবেশন করল। রাজা হবুচন্দ্র একটা কামড় দিয়েই লাফিয়ে উঠলেন— ওঃ খুব গরম! আমার মুখ পুড়ে গেল।
মন্ত্রী গবুচন্দ্র আর অন্যান্য সভাসদরাও লাফিয়ে উঠলেন— ময়রাকে শূলে চড়াও। এক্ষুনি শূলে চড়াও। কিন্তু রাজা হবুচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে সবাই চুপ। রাজা হবুচন্দ্র আবার বসলেন। মন্ত্রী, সভাসদরা বসলেন। এ বার হবুচন্দ্র তারিয়ে তারিয়ে লুচিতে মোড়া তরকারি গরম গরম খেতে লাগলেন। দশ-বারোটা খাবার পরে হবুচন্দ্র থামলেন। বললেন, মন্ত্রী গবুচন্দ্র, একজন ময়রা যা পারে, সেটুকু বুদ্ধিও তোমাদের ঘটে নেই। ময়রাকে পুরস্কার দিয়ে সসম্মানে বাড়ি পাঠাও, আর রাজ-রাঁধুনিকে বলো ওর কাছে লুচি-তরকারি রান্না শিখে নিতে। সেই দিন থেকে শুরু হল সিঙাড়ার প্রচলন।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ২৯ ফাল্গুন ১৪১১ রবিবার ১৩ মার্চ ২০০৫